“…………পরে অবশ্য ভাবিয়াছি, আমি তাহার কাছে বন্ধক রাখা কোন সম্পত্তি নহি যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া আমার মরিবার বা বাঁচিয়া থাকিবার সব আয়োজন করিতে হইবে! আড়াইকুড়ি বছর পার করিবার পরও তাই আজ স্বপ্ন দেখিতেছি, যদি আমার চোখে তুমি একটা ঝলমলে রাতের আকাশ আঁকিয়া দাও !”
এইটুকু পড়ে রাশেদুল ইসলাম চিঠির খাম হাতে নিলো। নীরাপুর থেকে মেহেরুন নেছা তার স্বামীকে নিয়ে এই চিঠিটা লিখেছে। প্রাপকঃ রাশেদুল ইসলাম।
কালো কালির সীলমোহরে পোষ্ট করার তারিখ উল্লেখ আছে; ৯ই মার্চ ১৯৫৯। রাশেদুলের হাতে পৌঁছতে প্রায় তিন মাস সময় লেগেছে। সে ঝটপট গোছগাছ করে নীরাপুরের ট্রেন ধরলো। তেমন প্রস্তুতি নেই। মেহেরুনের ঝলমলে আকাশটা আঁকার জন্য অবশ্য সে অন্তর ভরে জোছনা নিয়েছে।
ইতোমধ্যে নানান যাত্রীতে বগি ভরে গেছে। পুরুষ আছে, মহিলা যাত্রীও কম নয়। খোলা মাঠ, বন-পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ট্রেনটা ছুটে চলেছে। ট্রেনের হুইশেলের সাথে রাশেদুলের বুকটা মেহেরুনের জন্য হুহু করতে লাগলো। ব্যাগে রাখা পানের বাক্স থেকে এক খিলি পান মুখে নিয়ে চিবাতে লাগলো। কি জানি কী মনে করে সে মেহেরুন নেছার বর্তমান ঠিকানা আবার দেখে নিলো। বর্তমান ঠিকানাটা আদৌ বর্তমান আছে কিনা কে জানে? চিঠির একটা অংশে তার চোখ আটকে গেলো।
“মধুরাতে নরনারীর সুখ খুঁজিবার চিরন্তন আকুলতার বদলে সে কিছু একটা বুঝিয়া লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। যখন সে একটুকরা সফেদ কাপড় বিছানোর প্রস্তুতি লইতেছিল আমার বুঝিতে বাকি রহিলোনা যে, আদতে সে একটা ভোগ্য পণ্য যাচাই করিতে যাইতেছে। সফেদ কাপড়ের জমিনে দুই এক ফোঁটা লাল চিহ্ন দিয়াই কী তাহা হইলে জীবন সঙ্গীর দাম নির্ধারিত হয়?! বিষয়টা ভাবিয়া আমি খুব বিষণ্ন হইয়া পড়িলাম। জানালা খুলিয়া দেখিলাম, আকাশে কোথাও কোন তারা নাই”।
চিঠিতে এরপর একটু গ্যাপ দিয়ে মেহেরুন নেছা প্রশ্ন করেছে, “রাশেদুল তুমিই বলো, আত্মা কি বন্দীত্ব মানে?”
প্রশ্নটার জবাব রাশেদুল খুঁজলোনা। সে তার নিজের চোখের গহীনে একটা সমুদ্রের অস্তিত্ব অনুভব করলো। সেটার তীরভাঙ্গা জল ছিটকে গিয়ে চিঠির খামে পড়লো; ঠিক ওখানটায় যেখানে নীরাপুর লেখা আছে।
পরবর্তী স্টপেজের জন্য ট্রেন ছেড়ে দিলো। যতো যাত্রি নেমে গেছে তারচে কিঞ্চিত বেশী যাত্রি ওঠেছে বলে রাশেদুলের মনে হল। নতুন যাত্রিদের কারো কারো দিকে একটু চোখ রেখে সে চিঠির পরের অংশ পড়তে লাগলো।
“আমার তো মরিবার বয়স হইয়াছে। কিন্তু আমার স্বামী মধুরাতের মতোই এখনো আমাকে নিরন্তর যাচাই করিয়া চলিয়াছে। আমার গায়ের তাপমাত্রা আন্দাজ করিয়া এমন ইঙ্গিত করে যে, মন ভার হইয়া যায়। এই পঞ্চাশে গায়ে বেশি তাপ থাকিবার তো কতো কারণই থাকে ! তাহার ধারণা সঠিক হইলেও স্ত্রী হিসাবে আমি কী বলিবার অধিকার রাখিনা যে, পুরুষ তুমি নপুংসক হইলেই আমাকে কেন সব সক্ষমতা হারাইতে হইবে?
ইদানিং শরীরটা ভালো যাইতেছেনা। তুমি আসিলে বিষদ জানাইব। কয়দিন হইলো নতুন একটা বিষয় যোগ হইয়াছে। সে আমার অন্তর-সিন্দুকের চাবি চাহিতেছে। মনেতে কোন পুরুষের বসত রহিয়াছে কিনা সম্ভবত তাহা জানিতে চায়। তুমিই বলো, গোপন সিন্দুকের চাবি কী অন্য কাহারও হাতে কাজ করে?
আমার শরীর কেমন আচরণ করিবে এই জীবনে তাহা না হয় উনার কাছেই বন্ধক রাখিলাম; কিন্তু আত্মা? ইহা কিভাবে বন্ধক রাখিব? উনি তো আমার ঈশ্বর নহেন !
আচ্ছা রাশেদুল, আমাকে যদি সাথে লইয়া যাও; তুমি কি আমার ঈশ্বর হইবে?”
চিঠিতে আবার একটু গ্যাপ দিয়ে মেহেরুন নেছা প্রশ্ন করেছে; “ঈশ্বর না হয় পুরুষই হইলেন; কিন্তু স্বাধীনতার কী কোন লিঙ্গ আছে?”
প্রশ্নটা রাশেদুল বুক পকেটে ভাজ করে রেখে দিলো। সে জানে,যে সমান্তরাল রেললাইন দুটোতে ভর করে সে নীরাপুর যাচ্ছে সেই লাইন দুটো মিলনের চেষ্টা করলে এই রেলগাড়িটা কখনোই নীরাপুর যাবেনা!
loading...
loading...
ঝাঁপ দিয়ে চলে এলাম আপনার গল্পে। কিছুক্ষণ আগে বড় একটা মন্তব্য লিখেছিলাম। ইলেক্ট্রিসিটি যাবার সাথে সব মুছে গেলো। শুধু মনে আছে খুব মনযোগ দিয়ে কিছু একটা লিখছিলাম। বয়স হয়েছে, এখন আর সেই স্মরণ শক্তি নেই। তারপরও পূনর্পঠনের আগে ভাগেই আপনার জন্য এক রাশ শুভকামনা জানিয়ে রাখি মি. মিড ডে ডেজারট।
অণুগল্পের পরতে পরতে বা পলে পলে ষাটোর্ধ রাশেদুলের চোখে মেহেরুন নেছা 'র চিঠির অংশবিশেষ যেভাবে খুলেছে, তাতে করে আমার মতো ক্ষুদ্র পাঠকও দারুণ ভাবে সারপ্রাইজড হয়েছে। তৃতীয় নয়নে বারবার ভেসে উঠেছে মেহেরুন নেছা'র দাম্পত্য জীবনেও এককীত্বের জীবন একটি ছায়াছবি।
'রাশেদুল জানে, যে সমান্তরাল রেললাইন দুটোতে ভর করে সে নীরাপুর যাচ্ছে সেই লাইন দুটো মিলনের চেষ্টা করলে এই রেলগাড়িটা কখনোই নীরাপুর যাবেনা!'
loading...
আপনার বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছে। কৃতজ্ঞতা জানবেন মিঃ মুরুব্বী!
loading...
অনেকদিন পর আপনার লেখাটি পড়ে অশ্রুসিক্ত হলাম ভাই। জীবন এমন কেন হয়?
loading...
আপনার এমন আন্তরিক মন্তব্য আমাকে আন্দোলিত করেছে। অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
আচ্ছা রাশেদুল, আমাকে যদি সাথে লইয়া যাও; তুমি কি আমার ঈশ্বর হইবে?” একটু গ্যাপ দিয়ে মেহেরুন নেছা প্রশ্ন করেছে; “ঈশ্বর না হয় পুরুষই হইলেন; কিন্তু স্বাধীনতার কী কোন লিঙ্গ আছে?”
উত্তর হয়না এই প্রশ্নের ডেজারট ভাই। এমন অণুগল্প সচরাচর চোখে পড়ে না।
loading...
এমন মন্তব্যে মন ভালো হয়নি তা "সচরাচর চোখে পড়ে না"। অশেষ ধন্যবাদ কবি!
loading...
কবিতার ভীড়ে শব্দনীড় যখন জরাজীর্ণ তখন এমন কিছু লিখা শব্দনীড়কে সমৃদ্ধ করবে।
loading...
এই মন্তব্যটা আমার জন্য দারুণ একটা কমপ্লিমেন্ট! অশেষ ধন্যবাদ!
loading...
Voyaboho Shundor.
loading...
"ভয়াবহ সুন্দর" কমপ্লিমেন্ট! অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
“মধুরাতে নরনারীর সুখ খুঁজিবার চিরন্তন আকুলতার বদলে সে কিছু একটা বুঝিয়া লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল।" আহা। সমান্তরাল রেল লাইন যে কখনও এক হয় না।
loading...
সমান্তরাল রেললাইন এক হলে রেলগাড়ি কোনদিন নীরাপুর যাবেনা! অশেষ ধন্যবাদ দিদি!
loading...
* একটা শৈল্পিক লেখা…
শুভরাত্রি।
loading...
অশেষ ধন্যবাদ কবি!
loading...
রাশেদুল ইসলাম এর হাতে চিঠির খাম। মেহেরুন নেছা এবং তার স্বামী। অদ্ভুত ভাবে গড়ে উঠেছে নীরাপুর রেল যাত্রায় ক্ষণে ক্ষণে চিঠি পঠনে মেহেরুন নেছার জীবন। নীরাপুরের চিঠি। অসাধারণ একটি অণুগল্প।
loading...
কী অসাধারণ মন্তব্য! পুরো গল্পটাকে কয়েকটা শব্দে প্রকাশ করে শেষে একটা কমপ্লিমেন্ট যুক্ত করেছেন!
loading...
রেলগাড়িটা কোনদিনই নীরাপুর পৌঁছাতে পারে না। পৌঁছানো উচিত ও না ।জীবন বাস্তবতা অস্বীকার করে কোন জীবনই পূর্ণতা পায় না । গল্পটি আগেও পড়েছি ।ভালো লাগলো
loading...
জীবনের বাস্তবতা অস্বীকার করে আধুনিক গল্প লেখা যায়না! অন্যদিকে এটাও সত্য যে, সাহিত্যে বাস্তবতা এবং জীবনের বাস্তবতা এক নয় এবং এই ভিন্নতা মূলত প্রকাশে! কারণ সাহিত্যে (গল্পে) সুনির্দিষ্ট কিছু অনুষঙ্গ থাকতেই হয়; জীবনের বাস্তবতায় নয়। সমান্তরাল রেল লাইন এক হলে রেলগাড়ি কোন দিন নীরাপুর যাবেনা- এটা গল্পটার থিম (প্রাইমারী প্লটলাইন থেকে) যা মূলত একটা জীবন দর্শন!
মন্তব্য ভাল লাগলো!
loading...